এই ব্লগটি সন্ধান করুন

শনিবার, ১৪ মার্চ, ২০১৫

মানুষের কাছে ঋণ, মানুষের জন্য ভালবাসা


ভুপেন হাজারিকার এই গানটা প্রথম শুনেছিলাম কোন একটা বাংলা ছবিতে।কিন্তু গানটা যে কত সত্য তা আমরা অনুভব করি প্রতিনিয়ত। তাই না চাইতেও দেখা যায় আমরা অনেক মানুষকে ভালবাসি এবং তাদের জন্য কিছু করতে অন্তর থেকে সাড়া পাই। আর এভাবেই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা মানুষেরা একে অপরের ঋণ শোধ করে যাই।কিন্তু মানুষের কাছে যে ঋণ তা কি শেষ হবার? কিছু কিছু মুহুর্তে কিছু কিছু মানুষের কাজ অন্য আরেক মানুষকে আজন্মের জন্য ঋণী করে দেয়।শুধু অন্তর থেকে বয়ে আসা পবিত্র শ্রদ্ধায় এসব মানুষকে প্রতিনিয়ত স্মরন করে যাই আমরা। কারন কোন কিছুতেই যে এ ঋণ শোধ হবার নয়। আমি তখন ক্লাস ফাইভে। সিলেটে।আমরা থাকতাম সিলেটে জালালাবাদ আবাসিকে। তখন আমাদের পাশের বাসায় এক আংকেল আর এক আন্টি থাকত। আন্টি তখন মা হচ্ছিলেন। সিলেট ওসমানী হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হল। যেদিন ডেলিভারী সেদিন নাকি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার প্রায় মরণ দশা। উনার গ্রুপের রক্ত ও নাকি পাওয়া যাচ্ছিলনা। তখন সম্পুর্ণ অপিরিচিত এক মেডিকেলের ভাইয়া নাকি রক্ত দিয়ে সেই আন্টিকে বাঁচায়। ঐ আংকেল নাকি সেই ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। ছোট যে ছেলেটি তাদের হয়েছিল তার নাম রাখা হয়েছিল শাওন। শাওনের জন্মের পর আংকেল আন্টি সবাইকে দাওয়াত করে খাইয়েছিলেন। সেই ভাইয়াটাও ছিল।তারপর জীবনের নিয়মে জীবন দ্রুত চলে গেল। এরপর কোনদিন সেই ভাইয়াকে দেখিনি। কিন্তু সে যে এক অদ্ভুত আপরিমেয় ঋণের জালে তাদের রেখে গেল তার কি কোন শোধ আছে? অবশ্যই শাওনকে আন্টি সেই ভাইয়ার কথা বলেছিলেন। তার প্রতি শাওনের শ্রদ্ধা কি এ জীবনে কোনদিন শেষ হবে? জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার মনে থাকবে একজন মানুষের কারণে সে মাতৃহারা হয়নি। অপুর্ব। সদ্যই ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে। সরকারী কর্মচারী বাবা এ নিয়ে অনেক আনন্দিত এবং হালকা শংকিত। তার মাথায় চলছে ভর্তির যে টাকাটা সেটা কোথা থেকে জোগাড় হবে। কোন ভাবে টাকা জোগাড় হয়ে গেল। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশের পর সে জানতে পারল, তার ভর্তির ফি টা তখন তার বাবা অফিস সহকর্মী কাওসার সাহেবের কাছ থেকে ধার করে নিয়েছিলেন। সেই ধার ও শোধ হয়ে গেছে। কিন্তু তার মুল্য কি কখনো শোধ হবে? বিপদের সময় এতটুকু উপকার ও তাই অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায়। সারাজীবন ভাবায়। ছেলেবেলায় প্রায় ই ট্রেনে করে বাড়ি যেতাম আমরা। প্রতি বছর কম করে হলেও দুইবার। ক্লাস সিক্সে থাকতে আমাদের সাথে ট্রেনে পরিচয় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া হারুন ভাইয়ার। হারুন ভাইয়ার অসাধারন গুণ ছিল- মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার। যাত্রাপথের ছয় সাত ঘন্টা আমরা সেবার হারুন ভাইয়ার সাথেই কাটিয়ে দিলাম। খুব মন মন খারাপ হয়েছিল আমার আর ছোটবোন নোভার। ঈদের পর একদিন বাসায় এসে দেখি হারুন ভাইয়া বসে আছে। আমাদের খুশি কে দেখে? হারুন ভাইয়ার মাধ্যমেই আমার জীবনের প্রথম গৃহশহিক্ষকের পরিচয়।শুধু শিক্ষক বললে যাকে অপমান করা হয়। আমার আদর্শ আমার MENTOR রিপন ভাইয়া। রিপন ভাইয়া আমার চোখে স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিলেন। আমি আজ যতটুকে এসেছি তার এক বিশাল অনুপ্রেরণার নাম রিপন ভাইয়া। অসাধারন একটা মানুষ ছিলেন। স্বপ্ন দেখতেন দেখাতেন। আমার এখনো মনে পড়ে রিপন ভাইয়া নীল প্লাস্টিকের কক্স জ্যামিতি বক্স নিয়ে বাসায় আসতেন। আমি বলতাম ভাইয়া পরীক্ষা কেমন হল। আমাকে বলতেন, “ভার্সিটি লাইফের পরীক্ষা বুঝলি সবই ভাল আবার সবই খারাপ”। ভাইয়া যখন ছুটিতে বাড়ি যেতেন আমাদের বাসা থেকে খেয়ে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন। আমাদের পরিবারের এক অংশ ছিলেন ভাইয়া। ক্লাস এইট শেষে আমরা যখন চিটাগং চলে আসি তখন ভাইয়া একটা চিঠি দিয়েছিলেন আর সাথে একটা ফটোগ্রাফ। সেই চিঠি আমাকে সারা জীবন অনুপ্রেরনা দিয়ে যায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য। ভাইয়াদের বাসা ছিল ঢাকায়। তিনি পরে আমাকে কুরিয়ার করে অনেক স্টাডি ম্যাটেরিয়াল পাঠিয়েছিলেন।একজন হারুন ভাইয়া বা একজন রিপন ভাইয়ার কাছে আমার যে ঋণ তা শোধ হবার নয়। সারা জীবন জিঈয়ে রাখার। যা আমাকে তাদের মত হতে অনুপ্রাণিত করে। এভাবেই জেনে বা না জেনে , বুঝ বা না বুঝে আমরা মানুষ আশে পাশের সকলের কাছে ঋণী। উপরের তিন টা ঘটনা তার উদাহরণ মাত্র। এসকল ঋণ অর্থমূল্যে মাপার নয়, এসব ঋন অমুল্য দীপ্সহিখার মত আমাদের সামনে নিয়ে যায়।। আরো কিছু মানুষের জন্য কিছু করার। এভাবেই মনুষত্ব বেঁচে থাকে। মানুষ বেঁচে থাকে মানুষের ভালবাসা নিয়ে। ভার্সিটি লাইফে প্রথম যে ক্লাস তাতে মাশরুর স্যার বলেছিলেন তোমরা যে এত সস্তায় পড়ছ-ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছ তাতে অবদান আছে নাম না জানা কোন এক কৃষকের যে কাজের ফাঁকে যে বিড়ি টানছে তাতেও ট্যাক্স দিচ্ছে । আর এমন অগণিত মানুষের শ্রম থেকেই তোমাদের পড়ালেখার অর্থ আসে। অসাধারন এই মনুষত্ব। বেঁচে থাকুক মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা। কারন যেদিন এই ভালবাসা শেষ হয়ে যাবে-আমাদের কিছুই থাকবেনা- যার নিদর্শন অল্প অল্প হলেও বুঝ যায় আজকাল। ** অনেক দিন পর কিছু লিখলাম। আগে যখন নিয়মিত ছিলাম তাদের অনেকে দেখি নেই। আবার অনেক নতুন বন্ধুদের দেখা মিলছে। সবাই ভাল থাকুক এটাই আশা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন